কক্সবাজার প্রতিনিধি : নাফ নদী হয়ে টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে হাজার হাজার রোহিঙ্গারা। এরপর কক্সবাজার শহরের পাহাড়ি এলাকাসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিতে উখিয়া-টেকনাফ থেকে চলে আসছে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা। গত সোমবার থেকে উখিয়া-টেকনাফের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা শিবির ছেড়ে হঠাৎ শহরের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে স্রোতের মতো আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এতে নিরাপত্তা নিয়ে স্থানীয়রাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গার ঢল নামে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সীমান্ত এলাকায়। চাপ বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গারা দালাল অথবা আগে থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে বসবাস করা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি চট্টগ্রামের দিকেও চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। গত সোমবার থেকে শহরের পাহাড়তলী, বৈদ্যেরঘোনা, ঘোনারপাড়া, খাজামঞ্জিল, লাইটহাউজ, রুমালিয়ারছড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, বিজিবি ক্যাম্প এলাকা, কলাতলী আদর্শগ্রাম, সমিতিপাড়া, চন্দ্রিমা সমিতি এলাকা, নতুন জেলগেট এলাকাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্রোতের মতো ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকায় আগে থেকে পালিয়ে আসা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ও ভাড়া বাসা নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রতিদিন হাজারো রোহিঙ্গা শহরে ঢুকে পড়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে স্থানীয়রা আতঙ্কিত।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজার পৌর শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগর এলাকায় গিয়ে দেখা মেলে নতুন পালিয়ে আসা শতাধিক রোহিঙ্গার। সেখানে কয়েকটি বাড়িতে রোহিঙ্গাদের ভিড় দেখা যায়। নারী পুরুষেরা বাড়িতে বসে আছে। শিশুরা পাহাড়ের ঢালুতে বসে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে।
পাহাড়তলী জিয়ানগরে পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করেন দীল মোহাম্মদ (৪২)। তিনিও রোহিঙ্গা। পাঁচ বছর আগে তিনি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় বসবাস করছেন। তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে নারী-পুরুষ, শিশুসহ ২০ জন। তারা সবাই তার স্ত্রীর আত্মীয় স্বজন। ওই বাড়িতে স্ত্রী সন্তান ও নাতি নাতনী নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মো. হোছন (৫৫)। তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর ধাওনখালী গ্রামে।
তিনি বলেন, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহীর একটি দল হঠাৎ গ্রামে এসে নির্বিচারে গুলি চালায়। গত ২৮ আগস্ট ফের সেনাবাহিনী এসে তার ভাইয়ের ছেলে ওসমান গণি (২৬) ও ওমর ফারুককে (২৩) বাড়ির উঠানে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে পাহাড়ের পথ দিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এসে অবস্থান নেয়। গত সোমবার নৌকা নিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় চলে আসে। আসার সময় ওই মাছ ধরার নৌকার মাঝি তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা আদায় করে। তাদের হাতে নগদ টাকা না থাকায় স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করে। পরে হ্নীলার লেদা ক্যাম্পে একদিন থাকার পর গত বুধবার সেখান থেকে তার স্ত্রীর বোনের স্বামী দিল মোহাম্মদ তাদেরকে কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগরে নিয়ে আসে।
তিনি আরো বলেন, দিল মোহাম্মদ কয়েকবছর আগে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল। তারা পুরুষ রয়েছে চারজন। বাকিরা শিশু ও নারী। কয়েকদিন পর শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। দিল মোহাম্মদের পাশেই ভাড়া বাসা নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দিল মোহাম্মদ জানান, অসহায় হিসেবে তাদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের জন্য থাকা ও কাজের ব্যবস্থা করছেন তিনি। তিনি আরো জানান, জিয়ানগর এলাকা তার বাড়ি ছাড়াও বোরহান, হাবিবুর রহমান, আব্দুর রব, জসিম উদ্দিন, আবু জমিরসহ প্রায় ১১টি বাড়িতে প্রায় ২শ’ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। এসব বাড়ির মালিকরাও বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জিয়ানগরে বসবাস করছে।
জিয়াবুল হক বলেন, পাঁচদিন আগে তারা একই পরিবারের ১৭ জন টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন। নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে তারা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে নৌকায় উঠেন। নদীর মাঝ খানে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। প্রতিটি নৌকায় টাকা নেয়ার জন্য মাঝিসহ তিনজন অবস্থান করে বলে তিনি জানান।
পাহাড়তলীর জিয়ানগরে আশ্রয় নেয়া নুর বাহার (৪৫) বলেন, বোটে করে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য টাকা ছিল না। নিজের অল্প স্বর্ণালংকার দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি।
জিয়ানগরে আব্দুর রবের বাড়িতে ৬ সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জাহেদা বেগম (৩৯)। তার স্বামী কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে সহায়তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের বাড়ি মংডুর মেরুল্লা পশ্চিম পাড়া গ্রামে। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার নৌকা ভাড়া দিয়ে টেকনাফের শাপলাপুর এলাকায় উঠি। এরপর তার স্বামী কয়েকজন লোকের সঙ্গে কুতুপালং শিবিরে চলে যায়। আর অন্যান্য নারীর সঙ্গে তিনি গত বুধবার শহরের পাহাড়তলী জিয়ানগরে এসে আব্দুর রবের ভাড়া বাসায় ওঠে। পাহাড়তলীতে তাদেরকে নিয়ে আসেন টেকনাফের শাপলাপুর এলাকার জনৈক আব্দুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি।
তিনি আরো বলেন, তার কাছে কিছু টাকা ছিল সেগুলো দিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন তিনি। এখন টাকা পয়সা কিছুই নেই। গত বুধবার রাত থেকে তারা কিছুই খায়নি বলে জানান।
জিয়ানগরের পাশে বৈদ্যঘোনা খাজা মঞ্চিল পাহাড়েও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। সেখান থেকে পাহাড়তলী লাইট হাউজ সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখা মিলে একটি ছারপোকা গাড়ির। ওই গাড়িতে করে এসেছেন নতুন ২০ জন রোহিঙ্গা। তারা উঠেছেন লাইটহাউজ ফাতেরঘোনার মৌলভী ওসমান গনি নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে। তিনিও আগে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গা বহনকারি ওই গাড়ির চালক মো. আরিফের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শাপলাপুর এলাকা থেকে এসব রোহিঙ্গাকে বিজিবি সদস্যরা তার গাড়িতে তুলে দেয়। মৌলভী ওসমান গনির সঙ্গে রোহিঙ্গা যাত্রীরা মোবাইলে যোগাযোগ করে। লাইটহাউজ পৌঁছে গাড়ি ভাড়াও দেন মৌলভী ওসমান গনির স্ত্রী।
লাইটহাউজ ফাতের ঘোনা এলাকায় গত বুধবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। ফাতেরঘোনা এলাকায় আগে থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজনেরা বসবাস করছেন। বেশির ভাগই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে উঠেছেন।
লাইটহাউজ ফাতের ঘোনা সমাজ কমিটির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, দুইদিন থেকে রোহিঙ্গা আসা শুরু করেছে। তারা এখানে আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ জনের মত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তার এলাকায়।
নাফ নদী থেকে আরও ১১ মৃতদেহ উদ্ধার: নাফ নদীর টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট আরো ১১ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টা থেকে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে এসব মৃতদেহ ভেসে আসে। এরআগে বুধবার গভীর রাতে নাফ নদীতে রোহিঙ্গাবাহী দুটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে।
টেকনাফ থানার ওসি মাইন উদ্দিন খান জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে নাফ নদীতে নৌকাডুবিতে তাদের মৃত্যু হয়। মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে এলাকাবাসীর সহায়তায় বৃহস্পতিবার সাবরাং ইউনিয়নে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপে দুই শিশু ও দু’জন নারী, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন থেকে তিন শিশু, এক নারী ও বাহারছড়া ইউনিয়ন থেকে দুই শিশু ও এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সীমান্তে ২৫ নৌঘাটে দালাল: মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নাফ নদীর মাঝখানে টাকা স্বর্ণালঙ্কার কেড়ে নিচ্ছে দালালরা। বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার কথা বলে টেকনাফের অধিকাংশ জেলে নৌকার মালিক ও মাঝি জনপ্রতি আদায় করছে ১০ হাজার টাকা করে। টেকনাফের শামলাপুর থেকে শাহপরীরদ্বীপ পর্যন্ত ২৫টি নৌঘাটে দালালদের চলছে এই ব্যবসা।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ থেকে ৩০ জন ধারণক্ষমতার ছোট ছোট এই ফিশিং ট্রলারগুলো রাতের অন্ধকারে মিয়ানমার উপকূলে ভিড়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ পারে চলে আসে। এ সময় দালালরা জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা আদায় করছে। যারা টাকা দিতে পারছে না অথবা টাকার পরিমাণ কম তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে স্বর্ণালঙ্কার, কাপড়-চোপড়সহ যাবতীয় মূল্যবান সামগ্রী। আবার পরিবারের দুই একজন সদস্যকে বন্দি রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে দালালদের চাহিদা মতো টাকা সংগ্রহ করে আনতে। শুধু তাই নই, দালালদের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ থানার ওসি মো. মাইন উদ্দিন খান জানান, রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে যারা অপরাধ করছে সে সব দালালদের ধরতে পুলিশ কাজ করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪২ দালালকে সাজা দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, দালালদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে বোট মালিক এবং জেলেদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।
৯ দালাল আটক: রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তা ও বাসায় রোহিঙ্গা রেখে টাকা আদায় করার অভিযোগের অভিযান চালিয়ে ৯ দালালকে আটক করেছে বিজিবি। বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার সকালে তাদের আটক করা হয়েছে। তারা সকলে টেকনাফ ও শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা। পরে আটকদের টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে আদালতে প্রেরণ করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।